Monday, August 17, 2020

শুভ জন্মাষ্টমী, ২০২০

শুভ জন্মাষ্টমী / আবির্ভাব তিথি :
★★★★★★★★★★★★★★

পরমেশ্বর  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২৪৭ তম অাবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে সবাইকে জানাই,কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।

আবির্ভাব তিথিকেই আমরা জন্মাষ্টমী নাম দিয়েছি।আবির্ভাব শব্দের অর্থ, যিনি অবতরণ করেন বা নিজেকে প্রকাশ করেন।

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব:
*******************

গীতার শ্লোক দিয়েই শুরু করি, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, (৪/৬)

** " যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে,আমি আমার আদি চিন্ময় রুপে আবির্ভূত হই।"

ভগবানের জন্ম দিব্য ( গীতা, ৪/৯), অর্থাৎ সাধারন মানুষের মত নয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, দেবকী এবং বসুদেবের পুত্র রুপে আসলেন,কারন তাহারা পূর্বজন্মে ভগবানকে পুত্র রুপে চেয়ে ছিলেন।তাই ভগবান সরাসরি বিষ্ণু রুপেই তাদের পুত্র হিসেবে আসলেন।

** ভগবতে (১০/৩/৪৪) বলা হয়েছে,"পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করবার জন্যই আমি তোমাদের বিষ্ণু রুপ প্রদর্শন করতেছি।তা না হলে,আমি যদি একটি সাধারন  নরশিশু রুপে আবির্ভূত হতাম,তবে তোমরা বিশ্বাস করতে না যে,শ্রীবিষ্ণুই তোমাদের পুত্র রুপে আবির্ভূত হয়েছেন।"

বসুদেব তখন বিষ্ণু রুপী পুত্রকে দেখলেন,
আর বললেন।

** ভাগবত (১০/৩/১০) বসুদেব তখন দেখলেন যে, সেই নবজাত শিশুটির নয়নযুগল পদ্মের মতো, তার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম। তার বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন এবং গলদেশে কৌস্তুভ মনি বিরাজমান। তার পরনে পীত বসন, তার অঙ্গ কান্তি নিবিড় মেঘের মতো শ্যামল, তার কেশদাম উজ্জল এবং তার মুকুট ও কর্ণ কুণ্ডল বৈদুর্য - মণিচ্ছটায় অস্বাভাবিক ভাবে উজ্জ্বল।  সেই শিশুটি অত্যন্ত দীপ্তিশালী মেখলা, কেয়ূর,। বলয় প্রভৃতি অলংকারে শোভিত।

** ভাগবত (১০/৩/১১)  তার অসাধারণ পুত্রটিকে দর্শন করে বসুদেবের নয়নযুগল বিস্ময়ান্বিত হয়েছিল। চিন্ময় আনন্দে মগ্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব উৎসবে মনে মনে দশ হাজার গাভী, ব্রাহ্মণদের দান করেছিলেন।

**ভাগবত (১০/৩/১২) বসুদেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেই শিশুটি পরমেশ্বর ভগবান শ্রী নারায়ন। সেই সত্য নিশ্চিতভাবে হৃদয়ঙ্গম করে তিনি নির্ভয় হয়েছিলেন। এবং অবনত শরীরে কৃতাঞ্জলি হয়ে একাগ্রচিত্তে স্বাভাবিক কান্তির দ্বারা সূতিকাগৃহ উজ্জলকারী সেই বালকের স্তব করতে লাগলেন।

** ভাগবত (১০/৩/৩০) হে ভগবান! আপনি সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর, এবং শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম সুশোভিত আপনার চিন্ময় চতুর্ভূজ রুপ এই জগতের পক্ষে অস্বাভাবিক।দয়া করে আপনি আপনার এই রূপ সংবরণ করুন ( এবং একটি সাধারণ নর শিশুর রূপ ধারণ করুন, যাতে আমি আপনাকে কোথাও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারি)

** ভাগবত (১০/৩/৩১) প্রলয় এর সময়ে সমগ্র চরাচর সৃষ্টি আপনার চিন্ময় শরীরে প্রবেশ করে এবং আপনি অনায়াসে তা ধারণ করেন। কিন্তু এখন সেই চিন্ময় রূপ আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে। মানুষ তা বিশ্বাস করতে পারবে না এবং তাই আমি তাদের উপহাসাম্পদ হব।

** ভাগবত( ১০/৩/৪৬)   ভগবান শ্রীবিষ্ণু  তাদের সমক্ষেই তিনি তার অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা নিজেকে একটি প্রাকৃত শিশুতে রূপান্তরিত করেছিলেন।

ভগবান মানবরুপ ধারন করেছেন বলে,তাকে সাধারন মানুষ ভাবা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।

যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে ‘নরাধম’ বলিবে ৷”
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৬৫/১৯)
------------------------------------------------------
বিষ্ণু ও কৃষ্ণ :
************
আমরা এতক্ষণ ভগবানের আবির্ভাব সম্পর্কে জানলাম।
এবং এও জানলাম, বিষ্ণুই কৃষ্ণ বা কৃষ্ণই বিষ্ণু। শাস্ত্রে কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুকে কখনো আলাদা করে বলা হয়নি, শুধু দুটো রুপ মাত্র। কৃষ্ণ দ্বিভুজ এবং বিষ্ণু চতুর্ভুজ।
হে কৃষ্ণ, হে নারায়ন, হে গোবিন্দ, হে বিষ্ণু, এভাবেই দ্বিভুজ কৃষ্ণ এবং চতুর্ভুজ বিষ্ণুকে ডাকা হয়।

গীতাতেও (১০/২১) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,"আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু। "
আবার অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করলেন,গীতা(১১/২৪) " হে বিষ্ণু। "
আবার গীতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণু রুপ ধারন করলেন,গীতা ( ১১/৪৯) " আমার এই চতুর্ভুজ রুপ দর্শন কর।"

এভাবে মহাভারতেও বলা হয়েছে 
“সেই ভগবান বিষ্ণুই দুর্জ্জনের নিগ্রহ এবং ধর্ম্মরক্ষার জন্য মনুষ্যমধ্যে অবতীর্ণ হইয়া যদুকুলে জন্মিয়াছিলেন; তাঁহাকেই ‘কৃষ্ণ’ বলা হয় ৷” (বনপর্ব, ২২৬/৬৮)

**মহাভারত (বনপর্ব /৩৬/২৪) "কৃষ্ণরুপি বিষ্ণু। "

-----------------------------------------
শ্রীকৃষ্ণ কে?
*********

১/ শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। ( ভাগবত,১/৩/২৮)

২/ যাহার ব্যতিরিক্ত কিছুই নাই এবং যিনি অখিল জগতের বাহিরে থাকিয়া সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের কর্ত্তা,সেই ভগবান বাসুদেবকে নমস্কার। ( বিষ্ণু পুরাণ /১/১৯/৭৮)

৩/ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের মূল কারন।আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই।(গীতা,৭/৬-৭)

৪/ শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপী পরমব্রহ্ম। (মহাভারত/আদি/১/২১৯)

৫/ কৃষ্ণ ত্রিভূবন্থ সমস্ত চতুর্বিধ প্রাণীরই জন্ম ও মৃত্যুর কারন।(মহাভারত/ সভাপর্ব /৪৩/১৪)

--------------------------------------------
কৃষ্ণ কেন পৃথিবীতে আসলেন:
**************************
কৃষ্ণ পৃথিবীতে আসা,আর না আসাতে কোন কার্য বন্ধ থাকবে না।কোন কার্য করতে তার আসার প্রয়োজন নেই। তবু কেন তিনি আসেন। তিনি আসেন অহৈতকী কৃপা বসত।দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, ভগবান এমনিতেই করতে পারতেন,সে জন্য ভগবানের আসা লাগে না।প্রকৃত পক্ষে ভগবান আমাদের প্রতি কৃপা করে আছেন।এবং তিনি আদর্শ মানুষের মত আচরন করেন।যাতে করে আমরা তার কর্মের অনুসরন করতে পারি।

** মহাভারতে (সভাপর্ব /৩৫/১৬) বলা হয়েছে," জগদ্বীশ্বর মঙ্গলময় নারায়ন সকল দেবতাদের যদুবংশে জন্ম নিতে আদেশ করিয়া, নিজে যদুবংশে আসলেন।"

আর
**  ভাগবতে (১০/১৪/৫৫) বলা হয়েছে, "শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জীবের মূল আত্মা।তার অহৈতকী কৃপাবশত,সমগ্র জগতের মঙ্গলের জন্য,তিনি সাধারন মানুষরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তার অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে তিনি এটি করেছেন।"

-------------------------------------------------
কৃষ্ণই সবার আদর্শ:
*****************

কৃষ্ণ কেমন, যার মন যেমন।
আপনি যদি আদর্শ মানুষ হতে চান, সকল কাজে নিপুন হতে চান , আপনার বুদ্ধিমত্তাকে যদি উন্নত করতে চান,সকল কাজে সফলতা চান, তবে আপনাকে অবশ্যয় কৃষ্ণকে অনুসরণ করা উচিত।

কৃষ্ণকে জানতে, পড়তে হবে, মহাভারত,হরিবংশ,ভাগবত, বিষ্ণু পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ।কৃষ্ণ সম্পর্কে জেনে কখনো শেষ করা যায় না।তার মানবলীলাই এত বহুমাত্রিক, আর ঈশ্বরত্ত্ব কল্পনার বাহিরে।
রাজনীতি, কূটনীতি, নীতিশাস্ত্র, রাজধর্ম, সংসার ধর্ম সকল কিছুর আদর্শ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।তাই আমাদের ভগবানের আরাধনার পাশাপাশি, ভগবানের বীরত্বপূর্ণ কর্মেরও অনুসরন করা উচিত।

বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, 
" হিন্দুর আবার জাতীয় আদর্শ আছে নাকি? নাই বটে সত্য, থাকিলে আমাদের এমন দুর্দশা হইবে কেন? কিন্তু একদিন ছিল। তখন হিন্দুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। সে আদর্শ হিন্দু কে? রামচন্দ্রাদি ক্ষত্রিয়গন সেই আদর্শ প্রতিমার নিকটবর্তী, কিন্তু যথার্থ হিন্দু আদর্শ শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ একাধারে সর্বাঙ্গীন মনুষ্যত্বের আদর্শ। হিন্দু ধর্মের আদর্শ পুরুষ সর্বকর্ম কৃৎ, এখনকার হিন্দু সর্ব কর্মে অকর্ম । যেদিন সে আদর্শ হিন্দু দিগের চিত্ত হইতে বিদূরিত হইল, সেই দিন হইতে আমাদের সামাজিক অবনতি। এখন আবার সেই আদর্শ পুরুষ কে জাতির হৃদয়ে জাগ্রত করিতে হইবে। 

----------------------------------------------------
কৃষ্ণ আরাধনা:
**************

কৃষ্ণকে স্থান দিতে হবে, আমাদের হৃদয়ে, মনে প্রাণে।যে কৃষ্ণকে যত ভালোবাসে, সে তত বড় কৃষ্ণ ভক্ত।কৃষ্ণ আমার, আমি কৃষ্ণের,এই ভাব থাকবে সব সময়। 

ভগবান বিষ্ণু, কৃষ্ণ রুপে আসলেন, আবার বিষ্ণু রুপে চলে গেলেন,পথিমধ্যে দেবতাদের বলে গেলেন, (মহাভারত/মোষলপর্ব/৪/৩৩), "নারায়ন বললেন, দেবগন! আমার এই রুপ চতুর্ভুজ যুক্ত,এতদ ভিন্ন দ্বিভুজযুক্ত কৃষ্ণেরুপে মত্ত্যলোকে ছিলাম।তোমরা পৃ্থিবীতে আমার অপ্রমেয় মূর্তির পুজা করিও।"

সর্বশেষ মহাভারতের কথা দিয়েই শেষ করি।
♥♥ যে সকল মানুষ,পদ্মনয়ন কৃষ্ণের পুজা না করিবে, তাহাদেরকে জীবন্মৃত বলিয়া জানিবে,এবং তাহাদের সহিত কখনো আলাপ করা উচিত নয়।♥♥

*************
আবারো সবাইকে জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা।
কৃষ্ণ আমাদের সবাইকে মঙ্গল করোক।
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

 ♣ সমীর চন্দ্র পন্ডিত
  সনাতন ধর্মের প্রচার।।♣

No comments:

Post a Comment